ঢাকা , রবিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৫ , ১১ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
সংবাদ শিরোনাম
ট্রেনের টিকিট বিক্রির নামে প্রতারণা নানা হিসাব-নিকাশে অন্তর্বর্তী সরকার দেড় মাসেও সন্ধান মেলেনি সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া ১৮ জেলের জীবনযাত্রায় ভয়ানক চাপ নদী বাঁচলে পরিবেশও টিকে থাকবে -পরিবেশ উপদেষ্টা সচিবালয়ের ভবনগুলোতে পরিত্যক্ত মালামাল অপসারণের অনুরোধ চলন্ত অটোরিকশার পেছনে ঝুলে থাকা ব্যক্তিকে ছুরিকাঘাতের চেষ্টা, ভিডিও ভাইরাল গ্রেফতার বাবাকে ধরে কাঁদতে থাকা শিশুকে চড় খতিয়ে দেখছে পুলিশ নোয়াখালীতে ট্রলারবোঝাই ইউরিয়া সার জব্দ ঘরে ৩ বস্তা টাকা জমানো সেই ভিখারির মৃত্যু ‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব নয়’ মায়ের দাফন নিয়ে দুই গ্রুপে সংঘর্ষে নিহত ১ তিন শতাধিক পুলিশ সদস্যকে ব্রেস্ট ক্যান্সার বিষয়ে প্রশিক্ষণ সরকারে প্রশ্নবিদ্ধ ব্যক্তিরা থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়-আমীর খসরু বিএনপি ক্ষমতায় এলে শিক্ষা খাতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে-তারেক রহমান গৃহকর্মীদের অধিকার রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি-শিরীন পারভিন বিদেশ থেকে খালি হাতে ফিরছে প্রতারণার শিকার কর্মীরা ফরিদপুরের ভাঙ্গায় বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ২, আহত ৫ চেয়ারম্যানের ছেলেসহ হ্যাকার চক্রের তিন সদস্য গ্রেফতার সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ভবদহে খনন শুরু

‘প্রয়োজনের প্রিয়জন’

  • আপলোড সময় : ২২-০৯-২০২৫ ০৮:০৪:৩১ অপরাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২২-০৯-২০২৫ ০৮:০৪:৩১ অপরাহ্ন
‘প্রয়োজনের প্রিয়জন’
-মোঃ আবু সাঈদ
দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ, বাংলাদেশ এবং নেপাল, সাম্প্রতিক সময়ে দুটি ভিন্ন কিন্তু একইরকমের গণ-আন্দোলনের সাক্ষী হয়েছে। এই আন্দোলন দুটির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল জেন-জি বা তরুণ প্রজন্ম। বাংলাদেশের ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এবং নেপালের ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সংঘটিত এই আন্দোলন দুটিকে আপাতদৃষ্টিতে একইরকম মনে হলেও, এর গভীরতা এবং পরবর্তী পরিণতির মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য। এই দুটি আন্দোলনের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের তরুণদের পথচলা ও নেপালের তরুণদের ব্যতিক্রমী ভূমিকার একটি চিত্র তুলে ধরা। উভয় দেশের আন্দোলনই শুরু হয়েছিল আপাতদৃষ্টিতে ছোট একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। দুই দেশেরই সমাজের দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তরুণরা রাস্তায় নেমেছিলেন
বাংলাদেশের আন্দোলনের সূত্রপাত হয় সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে। এটি একটি পুরনো ইস্যু হলেও, আদালতের রায়ে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের আশঙ্কায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ চরমে পৌঁছায়। এই আন্দোলন শুরু থেকেই ছিল সুসংগঠিত এবং শান্তিপূর্ণ। তবে, যখন শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস দমন-পীড়ন শুরু হয়, তখন আন্দোলনটি শুধুমাত্র কোটা সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। পুরো আন্দোলন মোড় নিয়ে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে রূপান্তরিত হয়। এটি পরিণত হয় এক পূর্ণাঙ্গ গণঅভ্যুত্থানে। যা পরে 'জুলাই বিপ্লব' নামে পরিচিতি লাভ করে।
অপর দিকে নেপালে আন্দোলনের সূত্রপাত হয় সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম (যেমন: ফেসবুক, এক্স, ইউটিউব) নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে। এই সিদ্ধান্তকে তরুণ প্রজন্ম তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখে। বাংলাদেশের মতোই, নেপালের এই আন্দোলনও দ্রুত রূপ নেয় দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং দীর্ঘদিনের জমে থাকা রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভে। নেপালের জেন-জি প্রজন্ম 'নেপো কিডস' বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সন্তানদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে। যা বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো মেধা ও যোগ্যতার প্রতিবাদেরই প্রতিচ্ছবি।
নেপাল আর বাংলাদেশের আন্দোলনের মিলগুলো ছিলো-উভয় আন্দোলনেই নেতৃত্ব দিয়েছে তরুণ প্রজন্ম। বিশেষ করে জেন-জি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল উভয় আন্দোলনেরই মূল হাতিয়ার। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে জনগণের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ। উভয় ক্ষেত্রেই আন্দোলন দমনে সরকার সহিংস পথ বেছে নেয়, যার ফলে বহু প্রাণহানি ঘটে।
দুই দেশের গণআন্দোলনের অমিলগুলো হলো-আন্দোলনের স্থায়িত্ব: বাংলাদেশের আন্দোলনটি শুরু হয় জুলাই মাসের শুরুতে এবং ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের মাধ্যমে শেষ হয়। এটি দীর্ঘ প্রায় এক মাসের আন্দোলন ছিল। অন্যদিকে, নেপালের আন্দোলনের মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির পদত্যাগে বাধ্য হন।  
দাবি: বাংলাদেশের আন্দোলন কোটা সংস্কার থেকে শুরু হয়ে এক দফা অর্থাৎ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে পরিণত হয়েছিল। নেপালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের প্রতিবাদ থেকে আন্দোলনটি দ্রুতই প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দিকে মোড় নেয়।
পরবর্তী পদক্ষেপ: এটাই সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য। বাংলাদেশের তরুণরা সরকার পতনের পর ক্ষমতা গ্রহণের একটি প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ে। নেপালের তরুণরা কিন্তু ক্ষমতা থেকে দূরে থেকে নিজেদের দাবি পূরণের ওপর জোর দিয়েছে।
বাংলাদেশের ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়, তার নেতৃত্বে আসেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই সরকার গঠনে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের একটি অংশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক এবং নজিরবিহীন ঘটনা। তরুণরা, যারা এতদিন ক্ষমতার বাইরে ছিল, তারাই সরাসরি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসে। কিন্তু এই ঘটনায় বিতর্কও সৃষ্টি হয়।
আন্দোলনের এক অংশ ক্ষমতা গ্রহণের পর তাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ ওঠে। ক্ষমতায় আসার পর তারা নিজেদেরকে ‘প্রয়োজনের প্রিয়জন’ থেকে ‘ক্ষমতার প্রিয়জন’-এ পরিণত করতে থাকে। রাজনৈতিক দল গঠন, পদ-পদবি গ্রহণ এবং ক্ষমতার প্রলোভনে জড়িয়ে পড়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও ওঠে। তরুণ নেতৃত্বের এই বিতর্কিত ভূমিকা জনমনে হতাশার সৃষ্টি করে। অনেকে মনে করতে শুরু করে, ক্ষমতার বাইরে থেকে যে আদর্শের কথা বলা হয়েছিল, ক্ষমতার সংস্পর্শে এসে সেই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তরুণ নেতৃত্ব। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, শুধু প্রতিবাদ আর বিপ্লব নয়, ক্ষমতা গ্রহণের পর আদর্শ ধরে রাখা আরও কঠিন।
অপর দিকে নেপালের তরুণরা যেন বাংলাদেশের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছিল। যখন প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলির সরকার পদত্যাগ করে, নেপালের তরুণ আন্দোলনকারীরা কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের কোনো আগ্রহ দেখায়নি। তারা বরং নিজেদের মূল দাবি, সংসদ ভেঙে নতুন নির্বাচন। অন্তর্বর্তী সরকার গঠন।বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণের নির্দেশদাতাদের বিচারের মত দাবিগুলোর প্রতি অটল ছিলো।
নেপালের তরুণরা স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে, তাদের মূল লক্ষ্য ক্ষমতার ভাগীদার হওয়া নয়, বরং একটি সুষ্ঠু ও দুর্নীতিমুক্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। তারা মনে করে, রাজনৈতিক ক্ষমতা গ্রহণ করলে তারা সেই একই নোংরা রাজনীতির চক্রে জড়িয়ে পড়বে। যার বিরুদ্ধে তারা এতদিন লড়েছে। তাই তারা নিজেদের আন্দোলন সফল করে আবার নিজেদের অবস্থানে ফিরে গেছেন। কেউ কেউ বলছেন, তারা ফিরে গেছে 'পড়ার টেবিলে', কেউ বলছেন 'কর্মে'। তারা দেখিয়েছেন, দেশপ্রেমের জন্য সবসময় ক্ষমতায় বসার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শেষে নিজেদের দায়িত্বটুকু পালন করে ফিরে যাওয়াও এক ধরনের দেশপ্রেম। এই দৃষ্টান্ত নেপালের তরুণদেরকে 'প্রয়োজনের প্রিয়জন' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। যারা শুধু দেশের সংকটকালে সামনে আসে এবং সংকট সমাধান হলে আবার নিজেদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়।
বাংলাদেশের ৫ আগস্ট এবং নেপালের জেন-জি আন্দোলন দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ প্রজন্মের ক্ষমতার বিরুদ্ধে এক নতুন জাগরণের ইঙ্গিত দেয়। দুটি আন্দোলনই দেখিয়ে দিয়েছে, জেন-জি শুধু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সীমাবদ্ধ নয়। প্রয়োজনে তারা রাজপথে নেমে আসতেও প্রস্তুত। তবে, এই দুটি আন্দোলনের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো, সাফল্যের পরের ধাপ। বাংলাদেশের তরুণরা একটি ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তন করলেও, ক্ষমতা গ্রহণের প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ায় সমালোচিত হয়েছে। তাদের এই পদক্ষেপ প্রমাণ করেছে, পরিবর্তনের জন্য রক্ত দেওয়া সহজ কিন্তু ক্ষমতার লোভ এবং বিতর্ক থেকে নিজেদের মুক্ত রাখা কঠিন।
অন্যদিকে, নেপালের তরুণরা  অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রমাণ করেছে, সত্যিকারের দেশপ্রেম হলো প্রয়োজনের সময় সামনে আসা এবং প্রয়োজন শেষ হলে নীরবে নিজেদের কাজে ফিরে যাওয়া। তারা ক্ষমতাকে লক্ষ্য না করে, পরিবর্তনকে লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছে। তাই, নেপালের তরুণরা হয়ে ওঠেছে সবার 'প্রয়োজনের প্রিয়জন'। তাদের এই দৃষ্টান্ত শুধু নেপালের জন্যই নয়, বরং গোটা বিশ্বের তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি নতুন পথ খুলে দিয়েছে।

*লেখক: মোঃ আবু সাঈদ; ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

কমেন্ট বক্স
প্রতিবেদকের তথ্য